বর্তমান সময়ে আমাদের জীবনে খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান এর মতই আরও একটি জিনিস যেটি আমাদের অতি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে সেটি হল বিদ্যুৎ আমরা এখন প্রায় সর্বক্ষেত্রে সর্বদাই বিদ্যুৎ এর ব্যবহার করে থাকি। বিদ্যুৎ বা ইলেক্ট্রিসিটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা আমাদের জীবন পরিচালনার প্রায় সবকিছুই বিদ্যুতের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। আমাদের বাসা বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কলকারখানা থেকে শুরু করে আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গে আমাদের নিকটতম বন্ধু যাকে বলা যেতে পারে আমাদের হাতের সেই ভালোবাসার মোবাইলটিও বিদ্যুতের দাঁড়ায় পরিচালিত হয়। এছাড়াও বিদ্যুৎ আমাদের খাবার, পানি, লেখাপড়া ইত্যাদি সকল কাজে আমরা এখন ব্যবহার করি। কিন্তু পূর্বে একটি সময় এমন ছিল যখন পৃথিবীতে বিদ্যুৎ আবিষ্কার হয়েছিল না বা সে যুগের মানুষ বিদ্যুতের ব্যবহার জানতো না তখন তাদের জীবন পরিচালনার নিয়ম নীতিও ভিন্ন রকম ছিল। কিন্তু বর্তমানে আমরা এই ইলেকট্রিসিটি এর আবিষ্কারের মাধ্যমে আমাদের জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন লক্ষ্য করি কিন্তু আমরা কি জানি আসলে এই বিদ্যুৎ কিভাবে আবিষ্কার হয়েছিল আজ সে জন্যই এ বিষয়ে কিছুটা লেখার চেষ্টা করব যাতে করে আমি এবং আমার পাঠকগণ এ বিষয়ে কিছুটা জ্ঞান আহরণ করতে পারি।
সত্যিই কিছু কিছু আবিষ্কার হয় যা সম্পূর্ণ পৃথিবীটাকে বদলে ফেলে আর বিদ্যুতের আবিষ্কারটাও অনেকটা এমন তবে বিদ্যুতের অনুসন্ধান করা হয়েছিল আবিষ্কার যদিও আমরা এটাকে আবিষ্কার বলে থাকি তবে বাস্তবিক অর্থে বিষয়টি আমরা এভাবে বলতে পারি যে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছিল। বিদ্যুৎ আবিষ্কার হয়নি কারণ পূর্বে থেকেই বিদ্যুৎ আমাদের মাঝে ছিল শুধু আমরা তার ব্যবহার জানতাম না। একরকম বলা যেতে পারে যে যেভাবে আগুন এর অনুসন্ধান করা হয়েছিল আবিষ্কার নয় ঠিক তেমনি ভাবে বিদ্যুৎ এর ও অনুসন্ধান করা হয়েছে আবিষ্কার নয়। আসলে এনার্জি কখনো শেষ হয় না বরং তার রূপ পরিবর্তন করে বা দিক নির্দেশনা পরিবর্তন করে।
বিদ্যুৎ কে বা কারা অনুসন্ধান করে…? বিদ্যুৎ এর এই আবিষ্কার বা অনুসন্ধান যেটাই বলি না কেন এর মাঝে কোন একক ব্যক্তি এর কোন অনুদান নেই বরং এটি একের অধিক বিজ্ঞানী এই বিষয় নিয়ে বহুদিন গবেষণা করে ধাপে ধাপে এই বিদ্যুতের ব্যবহার এর পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। অবশ্যই প্রত্যেকটি বিজ্ঞানী এই বিষয়কে কেন্দ্র করে গবেষণা করার পর প্রত্যেকেই এক একটি বিষয় আমাদের সকলের জন্য সহজ করে দিয়েছেন এবং আমাদের মাঝে আজকের এই ইলেকট্রিসিটি পৌঁছে দেওয়ায় তাদের সেই অনুদান অতুলনীয়।
যদি বলি যে বিদ্যুৎ কত সালে অনুসন্ধান বা আবিষ্কার করা হয়েছিল….? এবং কে তা সর্বপ্রথম অনুসন্ধান করেছিলেন..? তাহলে উত্তরে বলা যেতে পারে যে আনুমান ৬০০ খ্রিস্টাব্দে একজন মহান বিজ্ঞানী থালেস তিনি এটা জানতে পারেন যে. কাঁচের টুকরো কে বিড়ালের লোম দিয়ে ঘষলে তার মধ্যে এমন একটি এনার্জির সৃষ্টি হয় যে, এর মধ্যে এমন একটি শক্তি চলে আসে যে নিজের তুলনায় হালকা কোন বস্তুকে যেমন কাগজের টুকরো যদিও এই থিওরির উপরে খুব বেশি একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যদিও অনেকে এই বিষয়টিকে কালো জাদু বলেও তকমা দিয়েছিল। এরপর পরবর্তীকালে থালেস নামক বিজ্ঞানী এটা নিয়ে অনেক রিসার্চ করেন।
এরপরে সেই রিসার্চ থেকে জানা যায় যে এটা কোন কালো জাদু নয় বরং এটি একটি বিজ্ঞান। গ্রীক ভাষায় আকাশকে ইলেকট্রন বলা হয়। এইজন্যই বিজ্ঞানী থালেছ তার এই অনুসন্ধান সেদিন করার পর সেটির নাম দেন ইলেকট্রিক। এরপরে 1752 সালে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নামক একজন বিজ্ঞানী এই বিষয়টি প্রমাণ করেন যে আকাশে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বিদ্যুৎ এবং বিদ্যুতের ফুলকি দুটো একই। এরপর তিনি এ বিষয়ে পরীক্ষা করার জন্য বর্ষার সময় একটি ঘড়ির মধ্যে ভেজা দড়ি এর বেঁধে দেন এবং তার উপরের অংশে একটি চাবি ঝুলিয়ে দেন এবং সে বুড়িটাকে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে উড়াতে থাকেন এবং এই পদ্ধতিতে যখন আকাশে বিদ্যুৎ চমকায় তখন ওই ঘুড়ির দড়ির সাহায্যে বিদ্যুতের শখ দড়ি বেয়ে চাবি পর্যন্ত আসে এবং বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বিদ্যুতের ঝটকা অনুভব করেন। এভাবেই সেদিন তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে এই পরীক্ষাটি করেছিলেন। এবং এর মাধ্যমেই এটি প্রমাণ হয়ে যায় যে আকাশের গর্জন করে ওঠা বিদ্যুত এবং আমাদের ব্যবহৃত ইলেকট্রিসিটি একই।
এরপর 1800 সালের দিকে ইতালিয়ান ফিজিসিস্ট অ্যালকস্যান্ডো ভোল্টা একটি দুর্দান্ত বিষয়ে অনুসন্ধান করেছিলেন তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনের মাধ্যমেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। যার ধারাবাহিকতায় তিনি একটি সেল আবিষ্কার করেন যার সাহায্যে বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। তিনি একটি বেটারির নেগেটিভ এবং পজেটিভ কানেক্টর ব্যবহার এটা আবিষ্কার করেছিলেন। এরপর এই বিজ্ঞানের নাম অনুসারে এটির নাম ভোল্টে ইউনিট রাখা হয়েছিল। ডিসি আবিষ্কারের পর ১৮৩১ সালে মাইকেল ফ্যারাডে বিদ্যুৎ অনুসন্ধানে সব থেকে বেশি ঝুলন্তকারী কাজটি করেছিলেন তিনি বলেন যে যদি একটি তামার কয়লের মধ্যে একটি চুম্বকের সামনে থেকে পেছনে ঘোরানো হয় তাহলে এর সাহায্যেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এই বিষয়টা কে কাজে লাগিয়েই ১৮৭৮ সালে আমেরিকার এক বিজ্ঞানী থমাস এডিসন এবং ইংল্যান্ডের অপর একজন বিজ্ঞানী জোসেফ সোয়ান পেমেন্ট লাইট বাল্ব আবিষ্কার করেন। আজও থমাস এডিসনকে বাল্ব এর আবিষ্কারক বলে মনে করা হয় যদিও এতে সোয়ান এরও অবদান ছিল ইতিহাসের এ পর্যায়ে পর্যন্ত বিদ্যুতের আবিষ্কারের পর ডিসি কারেন্ট টি ব্যবহার করা হচ্ছিল। আর ভুলটার এই ব্যাটারি ডিসি কারেন্ট অর্থাৎ ডিরেক্ট কারেন্ট জেনারেট করত যেখানে বিপদের সম্ভাবনাও অনেক বেশি ছিল। পাশাপাশি এর মধ্যে সবথেকে বড় সমস্যা এটা ছিল যে ডিসি কারেন্ট কে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন কিলোমিটার এলাকার মধ্যেই ট্রান্সমিট করা যেত যার ফলে দূরে কোথাও বিদ্যুৎ পাঠাতে হলে তার প্রত্যেক তিন কিলোমিটার এলাকায় প্রোডাকশন হাউজ বসানোর প্রয়োজন হতো।
অ্যাডিসন এর অফিসে ই আরো একজন মহান বিজ্ঞানী কাজ করতেন যার নাম ছিল নিকোলো টেসলা তিনি ডিসি কারেন্টের সমস্ত সমস্যা সম্পর্কে অবগত ছিলেন তাই তিনি এসি কারেন্ট এর উদ্ভাবন এর জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এসি অর্থাৎ অল্টারনেটিং কারেন্ট তিনি এমন ধরনের কারেন্ট তৈরি করতে চেয়েছিলেন যেটি সুরক্ষিত থাকবে এবং যার সাহায্যে অনেক দূর পর্যন্ত কারেন্ট সাপ্লাই করা যাবে। দেখুন বিজ্ঞানী টেসলা তার সমস্ত এক্সপেরিমেন্ট এর বিষয়ে বিজ্ঞানী এডিসনকে জানান তখন তিনি এসি কারেন্টকে গ্রহণ করতে প্রত্যাখ্যান করেন। এবং তিনি বিজ্ঞানী টেসলাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে তিনি যেন ডিসি কারেন্ট জেনারেটার এর উপরে সমস্ত এক্সপেরিমেন্ট করেন।
ইতিহাসের এ পর্যায়ে বিজ্ঞানী টেসলা তার এক্সপেরিমেন্টের একটি ভালো ফলাফল সকলকে উপহার দেওয়ার জন্য উক্ত বিষয়ে পেছনে না ফিরে তিনি সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য বিজ্ঞানী নিকোলো টেসলা বিজ্ঞানী এডিসন এর কোম্পানি ছেড়ে দেন এবং তিনি তার নিজ গতিতে অগ্রসর হতে থাকেন এবং এসি জেনারেটর ও এসি মটর এর ওপরে কাজ করতে থাকেন। ১৮৭৭ সালে নিকোলা টেসলা এসি কারেন্ট আবিষ্কার করেই ফেলেন। এসি কারেন্ট এমন একটি কারেন্ট ছিল যেটি কয়েকশো কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত কোন সমস্যা ও ভয় ছাড়াই ট্রান্সমিট করা যেত। এই ভাবেই বিদ্যুতের অনুসন্ধান এবং বিদ্যুৎ তৈরি করার পদ্ধতিতে একের পর এক অনেক বিজ্ঞানীর অবদান রয়েছে। আমরা এটি স্বীকার করতে বাধ্য যে তাদের সেই অবদানের সুফল আজ আমরা সর্বদা সকল জায়গায় ভোগ করছি। তাদেরকে কষ্টের সুফল আজ আমাদের জীবনকে একটি অন্যতম পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। হয়তো সেটা আমরা যদি একটু আমাদের দুচোখ বন্ধ করে ভেবে দেখার চেষ্টা করি যে আজ এই বিদ্যুৎ না থাকলে আমাদের জীবন থেকে কি কি জিনিস বিয়োগ হতো এবং আমরা কি কি সুবিধা ভোগ করতে পারতাম না বা আমরা এই বিদ্যুতের কারণে কি কি সুবিধা ভোগ করছি। অবশ্যই তারা প্রত্যেকেই প্রশংসার দাবিদার ও একেক জন সফল বিজ্ঞানী।
ভারতে বিদ্যুতের আবিষ্কার কবে হয়েছিল..?
অনেকের মনেই এই প্রশ্নটা আসতে পারে যে ভারতে কোথায় এবং কবে বিদ্যুৎ চালু হয়েছিল। ১৮৭৯ সালে ভারতের কলকাতা শহরে প্রথমবার বিদ্যুৎ চালু হয়েছিল। এবং ভারতের সর্বপ্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিটা ১৯৭৯ সালেই ভারতের কলকাতা শহরেই গড়ে উঠেছিল। এরপর ১৯০৫ সালের দিকে ডিজেলের সাহায্যে দিল্লিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা হয়েছিল। এরপর এরই ধারাবাহিকতায় একে একে ভিন্ন ভিন্ন শহরগুলোতে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় ভারত এবং বাংলাদেশ একটা দেশ হিসেবেই পরিচিত ছিল যে কারণে সমসাময়িক সময়ে বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরেও বিদ্যুৎ পৌঁছে গিয়েছিল। যে কারণেই আজ আমি বাংলাদেশে বিদ্যুতের আবিষ্কার কবে হয়েছিল..? এ কথাটি প্রথমে উল্লেখ না করে আমি ভারতে বিদ্যুৎ আবিষ্কার কবে হয়েছিল এটি উল্লেখ করি কারণ ভারতের বিদ্যুৎ আবিষ্কারের সঙ্গেই বাংলাদেশের বিদ্যুতের পথযাত্রা শুরু হয়।
বর্তমান সময়ে কিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়,,?
বর্তমান সময়ে দুই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যার প্রথমটিকে বলা হয় প্রাইমারি সোর্সেস এবং দ্বিতীয়টিকে বলা হয় সেকেন্ডারি সোর্সেস। এখন প্রশ্ন হল প্রাইমারি রিসোর্স ও সেকেন্ডারি সোর্স কাকে বলে। মূলত এই বিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রাইমারি সোর্সেস বলা হয় এমন একটি ফোর্সকে যেটি প্রকৃতি থেকে পাওয়া যায়। যেমন সূর্যের উত্তাপ, বাতাস, জোয়ার ভাটা এগুলো হলো এনার্জীর প্রাথমিক সম্পদ তবে এ সকল সম্পদ থেকে ক্রমাগত ইলেকট্রিসিটি প্রডিউস করা অনেক কঠিন একটি ব্যাপার যার কারণে এ সমস্ত সোর্সগুলো সীমিতভাবে ব্যবহার করা হয় ভারতে এগুলোকে বড় পরিসরে ব্যবহার করার জন্য গবেষণা করা হচ্ছে।
সেকেন্ডারি সোর্সেস বলা হয় জল, কয়লা, তেল এবং গ্যাস এগুলো হলো এনার্জীর সেকেন্ডারি সোর্স। এই সেকেন্ডারি সোর্সগুলো ব্যবহার করে প্রায় সব ধরনের ইলেকট্রিক সিটি উৎপাদন করা যায়। ভারত ও বাংলাদেশে এ সম্পদ গুলো বর্তমানে বড় পরিসরে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ সমস্ত সোর্সগুলো থেকে ইলেকট্রিক সিটি প্রোডাকশন কে ভিন্ন ভিন্ন টাইপ ও ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়েছে। সেগুলোর কিছুটা বলার চেষ্টা করছি। যেমন হাইড্রো ইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্লান্ট, থার্মাল ইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্ট, ডিজেল ইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্ট, নিউক্লিয়ার ইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্ট ইত্যাদি।