বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের এক বিস্ময়কর ইতিহাস

ইতিহাস

যুগে যুগে মানুষের জীবন সাধনের পথ হ্রাস পেতে থাকে এবং মানব সভ্যতা যুগে যুগে আরও উন্নত হতে থাকে এরাই ধারাবাহিকতায় প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে সকল গবেষকরা গবেষণা করে থাকেন তাদেরকে আমরা বিজ্ঞানী বলে সম্বোধন করে থাকি। মানব সভ্যতার বেশ বড় উন্নতি সাধন একমাত্র তাদের হাত ধরেই হয়েছে। মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ আরো আলোকিত হয়ে যায় যখন বিদ্যুৎ এবং বিদ্যুৎ বাল্ব আবিষ্কার হয়। কিন্তু বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ আলোর জন্য মশাল, বাতি 🕯️ মোম ও ইত্যাদি তেলের জ্বালানি ব্যবহার করত। এই জ্বালানি গুলো বেশি সময়ের জন্য ব্যবহার করা যেত না এছাড়াও বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো বিশেষ করে বাতাস বা পানির সংস্পর্শে আসলে এগুলো নিভে যেত। যার কারণে অন্যান্য সময় তো বটেই ঝড় ও বৃষ্টির সময় এটা নিয়ে সকলকে অত্যন্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো

তেল, গ্যাস ও হ্যারিকেনের ব্যবহার

পূর্বে আমরা হয়তো অনেকেই দেখেছি আমাদের বাবা দাদা দের আমলে তারা তেল এর বাতি ব্যবহার করত এবং হ্যারিকেন ব্যবহার করত যেটা তেলের মাধ্যমেই আমাদেরকে খুব সীমিত আকারে আলো প্রদান করত। ১৮০০ শতকের দিকে তেল এবং গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয়েছিল এই আলো পূর্বের অন্ধকারের থেকে যদিও আমাদেরকে আলোকিত করত কিন্তু বর্তমান সময়ের সাথে তুলনা করলে সে আলো আমাদের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হবে। সে সময় বিভিন্ন ধরনের হ্যারিকেন বা বাতি পাওয়া যেত এছাড়াও পাওয়া যেত মোমবাতি নামক এক ধরনের বাতি যেটা মোম দ্বারা বানানো হতো আমাদের মধ্যে অনেকে হয়তো এগুলো ব্যবহারও করেছি। কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের যারা উত্তরসূরী হবে তারা এগুলো থেকে বিরত থাকবে কারণ আমরাই এখন সেগুলোকে আর ব্যবহার করি না বা আমাদের প্রয়োজনে আসে না। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় এগুলো সকল জেনারেশনের জন্য একটি নিদর্শন হিসেবে উল্লেখিত থাকবে। কারণ যদিও বর্তমান যুগের সাথে সেগুলো যায় না কিন্তু পূর্বে এগুলো অনেক মূল্যবান একটি জিনিস ছিল যেটা উদ্ভাবনের জন্য অনেকেই রাত দিন পরিশ্রম করে সে পর্যায়ে পৌঁছেছিল এবং সকলকে ওই সুবিধা ভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছিল।

বিদ্যুৎ ব্যবহার করে আলো জ্বালানো

১৮০০ শতকে তেল ও গ্যাস ব্যবহার করে আলো জ্বালানোর প্রথা শুরু হলেও মনে রাখতে হবে দেশলাই এর মত একটি আলোকরশ্নীয় রাতারাতি আবিষ্কার হয়নি এর পিছনে অনেক বিজ্ঞানীর সময় ও সাধনা জড়িত রয়েছে। অনেক বিজ্ঞানীই এই বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কারের নিজেদের অবদান রেখেছে। তবে তা এতটা সহজ ছিল না বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার করে আলো জ্বালানোর সঠিক উদ্ভাবন করতে সক্ষম হচ্ছিলেন না কেউই। এরপর ১৮৭৯ সালে বিজ্ঞানী থমাস এডিসন সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে বৈদ্যুতিক বাল্ব এর প্যাটন করেন। এর অনেক আগে থেকেই বৈদ্যুতিক বাল্ব এর গল্পের শুরু হয়। অবশ্যই আজ আমাদের অন্ধকার ঘরকে যে আলোকিত করে সেই বাল্ব আমরা আজ যতটা সহজে পেয়েছি পূর্বে এ বিষয়টি এতটি সহজ ছিল না।

আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে এই গল্পের শুরু হয়েছিল। ঐতিহাসিক এই প্রচেষ্টার জন্ম লগ্ন ধরা হয় ১৮০০ সালকে সেই সময় ইটালিয়ান উদ্ভবক আলেসান্দ্রো ভোল্টা প্রথমবার জিংক এবং কপারকে একসঙ্গে করে ইলেকট্রিক ব্যাটারি উদ্ভাবন করেন। যেটা পৃথিবীর সর্বপ্রথম ইলেক্ট্রকেমিক্যাল সেল ছিল। একটি উদ্ভাবনের পর বিজ্ঞানী ভোল্টা তার ইলেকট্রিক সেল থেকে কপারের তার দিয়ে শর্ট করেন তখন তিনি দেখতে পান তারটি পুড়ে যাওয়ার পূর্বে কিছুক্ষণ উজ্জ্বল আলো এর সৃষ্টি করে। তার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাটিকেই বৈদ্যুতিক বাল্ব এর প্রথম নিদর্শন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় বিবেচিত হয়। এরপর ১৮০২ সালে ইংরেজ রসায়নবিদ ‌ হাম্ফে ডেভি বিশ্বের প্রথম ল্যাম্প আবিষ্কার করেন। দুটি কার্বন রডের মাঝখানে নির্গত উজ্জ্বল আলো এর কারণে এর এমন নাম করণ করা হয়েছিল। বিজ্ঞানী হামফ্রেন্ড ডেভি এর এই আবিষ্কার আর্ক ল্যাম্প নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে এর আলো এতই উজ্জ্বল ছিল যে ঘরে কিংবা কর্মস্থলে এটি ব্যবহার করা যেত না যার কারণে এটিকে স্টেট লাইট হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

১৮৪০ সালে ব্রিটিশ একজন বিজ্ঞানী প্লাটিনাম ফিলমিট ব্যবহার করে কয়েলের মত প্যাঁচানো একটি বাল্ব তৈরি করেন। কিন্তু platinum এর দাম বেশি হয় তার এই আবিষ্কারটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে ব্যর্থ হয়। এ ঠিক আট বছর পরে ১৮৪৮ সালে আরো একটি ইলেকট্রিক বাল্ব এর আবিষ্কার হয় কিন্তু সেটিও অনেক ব্যয়বহুল হয় বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে পারেনা। এরপর এ বিষয় নিয়ে আরো যারা গবেষণা করেছেন এবং সফল হয়েছেন তাদের কে নিয়ে আলোচনা করব কিন্তু আমরা অবশ্যই জানি যে হাত থেকে প্রায় ২০০ বছর আগেও সভ্যতা এমন একটি পর্যায়ে ছিল যখন রাত্রে চতুর্দিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকতো কারণ সে সময় আলোর কোন ব্যবস্থা ছিল না এরপর সময়ের ব্যবধানে যদিও মোমবাতি বা হারিকেন এর ব্যবহার শুরু হয় কিন্তু সেগুলোর আলো ছিল অতি সংকীর্ণ এবং যেকোনো কারণেই সেই আলো নিভে যেত যার কারণে মানুষের আলোর যে কষ্টটা সেটি থেকেই যেত এ সকল বিষয়ে চিন্তা করে দুইজন সফল বিজ্ঞানী জোসেফ সোয়ান এবং থমাস এডিসন এবার তাদের বাল্ব আবিষ্কার সম্পর্কে জানা যাক।

আমরা সকলেই জানি বিদ্যুৎ আবিষ্কার এরপর আলো আবিষ্কার এর গতি অত্যাধিক বেড়ে যায় অবশ্যই এর আবিষ্কার অনেক কঠিন এবং কষ্টসাধ্য ছিল। এমনও শোনা যায় যে প্রায় হাজারবার ব্যর্থ হওয়ার পর একজন বিজ্ঞানী যার নাম ছিল থমাস আলভা এডিসন তিনি বাল্ব আবিষ্কারে সফল হন। বিজ্ঞানী থমাস আলভা এডিসন ১৮৪৭ সালের ১১ ই ফেব্রুয়ারি আমেরিকার ওয়াহিউতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণে একটি সময় তাকে স্কুল ত্যাগ করতে হয়। তবে তিনি কখনো হার মানতে শেখেননি তিনি সময়ের অনেক মূল্য দিতেন যার কারণে তিনি স্কুল ছাড়লেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। এবং এ বিজ্ঞানী বাল্যকাল থেকেই বিভিন্ন জিনিস আবিষ্কার এর স্বপ্ন দেখতেন। তার বয়স যখন ১০ বছর সেই সময়ই তিনি তার বাসায় একটি ল্যাবরেটরি বানিয়ে ফেলেন। এরপর তিনি যখন দেখেন তার এই আবিষ্কার ও বিভিন্ন জিনিস এর পরীক্ষা করার জন্য যে পরিমাণ অর্থ এর প্রয়োজন তা তার পরিবার দিতে সক্ষম নয় তখন তিনি টেনে খবরের কাগজ বিক্রি করতেন এবং মাঝে মাঝে সবজি ও বিক্রি করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়সে একটি প্রিন্টিং প্রেস কেনেন যার নাম উইকলি হিরোর। এই নামে তিনি তার নিজের সংবাদপত্র ছাপান যার এডিটর তিনি নিজেই ছিলেন। তারই আবিষ্কারের কারণে আমরা রাত্রিকালীন এই আলোকিত পৃথিবী উপভোগ করতে পারি। বলা হয়ে থাকে তিনি ইলেকট্রিক বাল্ব আবিষ্কার করতে গিয়ে প্রায় এক হাজার বার ব্যর্থ হয়েছেন এ বিষয়ে এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিল আপনি এক হাজার বার ব্যর্থ হয়েছেন তাহলে কি আপনি এই ইলেকট্রিক বাল্ব আবিষ্কার এর চিন্তা ত্যাগ করবেন তখন তিনি সে সাংবাদিককে উত্তরে বলেছিলেন, হতে পারে আমি ইলেকট্রিক বাল্ব আবিষ্কার এর সঠিক পদ্ধতি এখনো পর্যন্ত উদ্ভাবন করতে পারিনি কিন্তু কিভাবে ইলেকট্রিক বাল্ব আবিষ্কার করা সম্ভব নয় তার ১০০০টি পদ্ধতি আমি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি।

তিনি এতটাই পজিটিভ মাইন্ডের মানুষ ছিলেন। বলা হয়ে থাকে যখন তিনি নতুন কোন জিনিস এর আবিষ্কার করার চেষ্টা করতেন তখন তিনি না ঘুমিয়ে টানা ৩-৪ দিন জেগে জেগে কাজ করতেন এমনকি মাঝে মাঝে তিনি খেতেও ভুলে যেতেন। বিজ্ঞানী থমাস যখন বৈদ্যুতিক বাল্ব এর আবিষ্কার শুরু করেন তখন তিনি তার পূর্বে যে সমস্ত বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কার হয়েছিল তা পরীক্ষা করা শুরু করেন। এরপর তিনি তার এই বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে লক্ষ্য করেন কোন ধাতুকে যদি সাধারণ হাওয়ায় গরম করা হয় তাহলে তার আলোর পরিমাণ অনেক কমে যায় যার কারণ ধাতুটি গরম হলে তার সাথে প্রকৃতির সাধারণ হওয়া ও অক্সিজেন এর বিক্রিয়া হয় ফলে ধাতু গরম হয়ে অধিক আলো সৃষ্টি করতে পারে না। এরপর তিনি তার উদ্ভাবনী ব্রেইন এর চিন্তাধারার মাধ্যমে অন্য একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনি এই ধাতুটিকে একটি আবদ্ধ জায়গায় নিষ্ক্রিয় গ্যাস এর মাধ্যমে গরম করেন তখন দেখা যায় এই ধাতুটি গরম হয়ে অনেক বেশি আলো প্রদান করতে সক্ষম হচ্ছে। যার কারণ ছিল নিষ্ক্রিয় গ্যাস কোনরকম বিক্রিয়া করে না।

১৮৭৯ সালে বিজ্ঞানী থমাস একটি কাঁচের আবদ্ধ পাত্র ব্যবহার করেন এবং তার মধ্যে ফিলামেন্ট হিসেবে কার্বন এর পুড়ে যাওয়া কটন এর ব্যবহার করেন আর এই পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি সফল হন। অবশ্যই এতে পাওয়া আলো এর পরিমাণ ছিল অনেক বেশি উজ্জল এবং এটি অনেক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আলো প্রদান করতে সক্ষম ছিল। থমাস তার এই আবিষ্কারের পর তার নিজের একটি কোম্পানি উদ্ভাবন করেন যেখানে তিনি ইলেক্ট্রিসিটি তৈরি করতেন যে ইলেকট্রিসিটি এর সাহায্যে তার কোম্পানি এর বানানো ইলেকট্রিক বাল্ব চলতো। বিজ্ঞানী থমাস এডিশন বৈদ্যুতিক বাল্ব ছাড়াও আরো অনেক কিছু আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম ভিডিও ক্যামেরা এর আবিষ্কার করেছিলেন। যাতে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২৫ টি ছবি উঠানো যেত এছাড়াও টেলিফোনে আরও অধিক স্পষ্টভাবে যাতে তথ্য আদান প্রদান করা যায় সেটিও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। বিজ্ঞানী থমাস এডিসন এর নামে ১০৯৩ টি বস্তু আবিষ্কারের প্যাটন রয়েছে। এই মহান বিজ্ঞানী ১৯৩১ সালের ১৮ই অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তার স্মরণে সে সময় আমেরিকার সকল ইলেকট্রিক বাল্ব এক মিনিটের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। অবশ্যই থমাস এডিসন এর ইলেকট্রিক বাল্ব আবিষ্কারের পরেও আরো উন্নতি সাধনের জন্য এখনো পর্যন্ত আরো অনেকের অবদান রয়েছে এবং বর্তমান ইলেকট্রিক বাল্ব আমরা এভাবেই পেয়েছি।

বাংলাদেশে ইলেকট্রিক বাল্ব এর ব্যবহার

সারা বিশ্বের নয় বাংলাদেশেও বৈদ্যুতিক বাতি এর অবদান সময়ের সাথে সাথে সকলের দাবি। বৈদ্যুতিক বাতি ছাড়া এখন প্রায় কোন কাজই করা যায় না কলকারখানা থেকে শুরু করে অফিস আদালত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি বাসা বাড়িতেও এর অধিক অবদান রয়েছে আমরা কোন জায়গাতেই বৈদ্যুতিক বাতি ছাড়া অন্ধকার পরিবেশ চিন্তা করতে পারি না। পৃথিবীতে বৈদ্যুতিক বাতি এর আবিষ্কার প্রায় ২০০ বছর এর কাছাকাছি হলেও বাংলাদেশের বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলেছে প্রায় শতাধিক বছর আগে। ঢাকায় ২ শতাব্দীতে বৈদ্যুতিক সড়ক বাতি চালু হলেও পূর্ববঙ্গে প্রথম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী ছিলেন গাজীপুর জেলার ভাওয়াল-পর্বনার রাজা বলা হয়ে থাকে উনিশ শতকেই তিনি বিলের থেকে জেনারেটর আমদানি করে রাজবাড়ী আলোকিত করেছিলেন। এরপর ১৯০১ সালে বাংলাদেশে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে ওঠে। ঢাকা কে বাংলার রাজধানী ঘোষণা করার পরও ঢাকাবাসীকে বিদ্যুতের জন্য অনেক বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল তখনো বাংলাদেশের সড়কে কেরোসিন এর বাতি বা হারিকেন জ্বলতো। যদিও সকল সড়কে এই ব্যবস্থাটুকু ছিল না। যে সকল জায়গায় এই ব্যবস্থাটুকু ছিল সেখানেও সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতেই এটি নিভে যেত আর নেমে আসতো অন্ধকার। মজার ব্যাপার হলেও সত্য এ সকল বাতি জ্বালানো এবং নিভানোর জন্য উনিশ শতকে বাতিওয়ালা নামক একদল কর্মজীবীকে নিয়োগ করা হয়েছিল। সন্ধ্যা নামলে বড় বড় মহি হাতে এই বাতিওয়ালাদের দেখা মিলত যারা ওইময় ওঠে সড়ক বাতিগুলো জ্বালিয়ে দিত। এরপর ১৮৮৬ সালে নবাব আব্দুল গনি কেসি এসআই উপাধি লাভ করলে তার পুত্র নবাব আহসানুল্লাহ ঢাকার রাস্তায় গ্যাস বাতি বসানোর ঘোষণা করেন।

এটা সত্য যে এই গ্যাস বাতি বসানোর ব্যর্থতার পরবর্তী ধাপ হিসেবেই ঢাকায় বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে ওঠে। ১৮৮৮ সালে ভারত বর্ষ থেকে নবাবের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য একজন ঢাকার রাস্তায় গ্যাস ব্যাপী স্থাপনের জন্য আসেন এবং তিনি চলে যাওয়ার পর কার্যক্রম একরকম স্থগিত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এই প্রতিশ্রুতি এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য আরও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর দীর্ঘ সময় পর নবাবের প্রতিশ্রুতির কথা মানুষ যখন ভুলতে বসেছে তখন ১৮৯৭ সালে নবাব আহসানুল্লাহ এর বোনের স্বামী নবাব খাজা ইউসুফ জাহান পৌরসভার সভাপতি হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পত্রপত্রিকায় আবারও সড়ক বাতি স্থাপনের বিষয়টি জনমানুষের মনে দাগ কাটতে থাকে। নবাব আহসানুল্লাহ কে উদ্দেশ্য করে লেখা হয় যে এতদিন হয়তো তিনি পৌরসভা এর ওপর ভরসা রাখতে পারতেন না কিন্তু এখন যেহেতু তিনি নিজেই পৌরসভা এর সভাপতি তাই এখন সড়ক বাতি এর আশা করতে আমাদের সকলের আর কোন দ্বিধা নেই। হয়তো এই পত্রপত্রিকার লেখালেখি ও সমালোচনার কারণেই নবাব আহসানুল্লাহ সত্যিই সড়ক বাতি স্থাপনের ব্যবস্থা করেন।

তবে তিনি এবার আর গ্যাস বাতি বা তেল বাতি দিয়ে সড়কগুলোকে আলোকিত করলেন না বরং তিনি বিলেতি বিদ্যুৎ বাতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো আলোকিত করলেন । সে সময়ের উল্লেখিত সড়কগুলো ছিল রহমতগঞ্জ রোড, চকবাজার সার্কুলার রোড, বাবুবাজার রোড, কমিটি গঞ্জ রোড, মোগলটুলি রোড, নালগোলা রোড, আর্মেনিয়া স্ট্রিট বা রাইবাহাদুর সড়ক পর্যন্ত। আহসানিয়া মঞ্জিল রোড, পাঁচুয়া টু ডি রোড, ওয়াইজঘাট রোড, পাটুয়া টুলি লোয়ার রোড, বাংলাবাজার রোড, ডালবাজার রোড, ফরাসগঞ্জ থেকে লোহারপুর রোড, দিগ বাজার রোড, ভিক্টোরিয়া পার্ক, লক্ষীবাজার রোড, সদরঘাট রোড, শাঁখারী বাজার রোড, জনসন রোড, নবাবপুর রোড, রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টার রোড, রমনা টিচিং গ্রাউন্ড পর্যন্ত, জামদানি নগর রোড, রাজার দেউরি লেন সহ, সাহেব বাজার পর্যন্ত, যতগুলো রাস্তা সংযোগ রয়েছে। এই লক্ষ্যে the Dhaka electric light trusted নামক একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বাতি স্থাপন এবং তারক্ষনাবেক্ষণের জন্য কমিটির ফান্ডে নবাব আহসানুল্লাহ প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টাকা দান করেন। এছাড়াও তিনি শুধু অর্থই নয় বৈদ্যুতিক বাতিল ব্যবহারে সার্বিক সহযোগিতার দায়িত্ব তিনি নিজেই গ্রহণ করেন। এরপর ৭ ডিসেম্বর ১৯০১ সালে ঢাকার রাস্তায় সর্বপ্রথম বিদ্যুতের বাতি জ্বলে ওঠে। সেই একই দিনে নবাব আহসানুল্লাহ এর পুত্র খাজা আতিকুল্লাহ এর বিবাহের অনুষ্ঠান ও অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

সে বছর সারা বাংলা জুড়ে হাড় কাঁপানো শীত পড়েছিল কিন্তু এরপরও শীতকে উপেক্ষা করে নগরবাসী সেদিন আহসান মঞ্জিল এর সামনে উপস্থিত হল। মঞ্জিলের দোতলার বারান্দায় অধিবেশন বসে ছিল। ছোটলাট স্যার জন উডবার্নকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি এসে বিদ্যুৎ প্রজ্জ্বলন করবেন, এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু অসুস্থতার জন্য লাটসাহেব আসতে পারলেন না। তখন জনাব চার্লস ওয়াল্টার বোল্টন কে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করা হয় যিনি কলকাতার রাজস্ব বোর্ডের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি সভায় উপস্থিত হয়ে সকলের মাঝখানে বসলেন তার ডান দিকে আসন গেড়ে বসে ছিলেন নবাব আহসানুল্লাহ এবং বাঁ দিকের আসনে বসেছিলেন পৌর কমিশনার অধিবেশন শেষ হলে জনাব চার্লস ওয়াল্টার বোল্টন সাহেব একটি সুইচ চাপ দিলেই মুহূর্তের মধ্যে জ্বলে উঠলো উজ্জ্বল বাতি এবং চারিদিক আলোকিত করে দিল। সে সময় যেহেতু সকলে তেল ও গ্যাস এর আলোর সাথে পরিচিত ছিল তাই তখন এ বিষয়টি যেন এক অলৌকিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে এমনটাই সকলের মনে চিন্তা আশা স্বাভাবিক। অবশ্যই সেসময়ের সাধারণ মানুষের কাছে এটি এক বিস্ময়কর ব্যাপার। বাংলাদেশের সকলে সেদিন এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে উঠলো। যারা এতদিন কেরোসিন বাতি ও চাঁদের আলো দেখে অভ্যস্ত তারা আজ বৈদ্যুতিক বাতি এর সাহায্যে প্রথমবারের মতো পুরো ঢাকাকে আলোকিত দেখল। এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেদিন তিনি বাংলাদেশের সড়কগুলোকে আলোকিত করে দিয়ে তার সপ্তাহখানেক পরে ১৬ই ডিসেম্বর ইহলোক ত্যাগ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *